ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্যগুলো দেশের সম্পদ। জিআই স্বীকৃতি ও সনদের মাধ্যমে রাষ্ট্র একটি পণ্যের স্বত্ব লাভ করে। দেশের জিআই পণ্য স্বীকৃতি ও সুরক্ষার জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতায় ‘পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্কস (ডিপিডিটি)’ নামক একটি অধিপ্তর কাজ করছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে উৎপাদিত বিশেষগুণ সম্পন্ন পণ্যগুলোর আবেদন পাওয়ার প্রেক্ষিতে আইন-২০১৩ ও বিধিমালা-২০১৫ অনুযায়ী জিআই স্বীকৃতি ও সনদ দিয়ে থাকে এই অধিপ্তর। ২০১৬ সালের ১৭ই নভেম্বর জামদানিকে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের জিআই স্বীকৃতির আনুষ্ঠানিকতা পেয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের সর্বমোট জিআই পণ্য ২১টি। জার্নালে আছে আরও ১০টি। ২ মাসের মধ্যে কোন বিরোধীতা না আসলে দেশের স্বীকৃত জিআই পণ্যের সংখ্যা ২১ থেকে ৩১টিতে উন্নতি করবে। নিয়মিত বাড়ছে জিআই পণ্য এবং জার্নালের সংখ্যা।
আরও পড়ুন: জিআই পণ্যের প্রশ্ন ও উত্তর।
Table of Contents
জিআই পণ্য কতটি?
জিআই | পণ্যের নাম | আবেদনকারী | আবেদন নং | আবেদন তারিখ | সনদ প্রদান |
০১ | জামদানি শাড়ি | বিসিক | ১/২০১৫ | ১০.০৯.২০১৫ | ১১.১১.২০১৬ |
০২ | বাংলাদেশ ইলিশ | মৎস্য অধিদপ্তর | ২/২০১৬ | ১৩.১১.২০১৬ | ১৭.০৮.২০১৭ |
০৩ | চাঁপাই নবাবগঞ্জের খিরসাপাত আম | বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট | ৩/২০১৭ | ০২.০২.২০১৭ | ২৭.০১,২০১৯ |
০৪ | বিজয়পুরের সাদামাটি | জেলা প্রশাসন নেত্রকোণা | ৫/২০১৭ | ০৬.০২.২০১৭ | ১৭.০৬.২০২১ |
০৫ | দিনাজপুরের কাটারীভোগ | বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট | ৬/২০১৭ | ০৬.০২.২০১৭ | ১৭.০৬.২০২১ |
০৬ | বাংলাদেশ কালিজিরা | বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট | ৭/২০১৭ | ০৭.০২.২০১৭ | ১৭.০৬.২০২১ |
০৭ | রংপুরের শতরঞ্জি | বিসিক | ৩৪/২০১৯ | ১১.০৭.২০১৯ | ১৭.০৬.২০২১ |
০৮ | রাজশাহী সিল্ক | বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ড | ২৭/২০১৭ | ২৪.০৯.২০১৭ | ১৭.০৬.২০২১ |
০৯ | ঢাকাই মসলিন | তাঁত বোর্ড | ৩০/২০১৮ | ০২.০১.২০১৮ | ১৭.০৬.২০২১ |
১০ | বাংলাদেশের বাগদা চিংড়ি | মৎস্য অধিদপ্তর | ৩২/২০১৯ | ০৪.০৭.২০১৯ | ২৪.০৪.২০২২ |
১১ | রাজশাহী-চাপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম | ১. ফল গবেষণা কেন্দ্র, বিনোদপুর ২. চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি এসোসিয়েশন | ১৫/২০১৭ | ০৯.০৩.২০১৭ | ২৫.০৪.২০২৩ |
১২ | বাংলাদেশের শীতলপাটি | বিসিক | ৩৭/২০২১ | ১৬.০৩.২০২১ | ২০.০৭.২০২১ |
১৩ | বগুড়ার দই | রেঁস্তোরা মলিক সমিতি, বগুড়া | ২৯/২০১৮ | ০১.০১.২০১৮ | ২৫.০৬.২০২৩ |
১৪ | শেরপুরের তুলশীমালা ধান | জেলা প্রশাসন, শেরপুর | ৩১/২০১৮ | ১১.০৪.২০১৮ | ১২.০৬.২০২৩ |
১৫ | চাঁপাইনবাবগঞ্জের ল্যাংড়া আম | আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র চাঁপাইনবাবগঞ্জ | ১০/২০১৭ | ১৯.১২.২০১৭ | ২৫.০৬.২০২৩ |
১৬ | চাঁপাইনবাবগঞ্জের আশ্বিনা আম | আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র চাঁপাইনবাবগঞ্জ | ১১/২০১৭ | ১৯.১২.২০১৭ | ২৫.০৬.২০২৩ |
১৭ | নাটোরের কাঁচাগোল্লা | জেলা প্রশাসন, নাটোর | ৪০ | ৩১.০৩.২০২৩ | ০৮.০৮.২০২৩ |
১৮ | বাংলাদেশ ব্লাক বেঙ্গল ছাগল | প্রাণি সম্পদ অধিদপ্তর | ২৮/২০১৭ | ২৫.১০.২০১৭ | ০৯.০১.২০২৪ |
১৯ | টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম | জেলা প্রশাসন, টাংগাইল | ৪১ | ০৩.০৩.২০২৩ | ০৯.০১.২০২৪ |
২০ | কুমিল্লার রসমালাই | জেলা প্রশানস, কুমিল্লা | ৪২ | ১৬.০৪.২০২৩ | ০৯.০১.২০২৪ |
২১ | কুষ্টিয়ার তিলের খাজা | জেলা প্রশানস, কুষ্টিয়া | ৪৩ | ১৭.০৪.২০২৩ | ০৯.০১.২০২৪ |
জিআই পণ্যের জার্নাল
পণ্যের নাম | আবেদনকারী | আবেদন নং | আবেদনের তারিখ | |
০১ | রংপুরের হাড়িভাঙ্গা আম | আলহাজ্ব আব্দুস সালাম সরকার হাড়িভাঙ্গা আম কৃষক স্কুল | ০৪ | ২৬.০১.২০১৭ |
০২ | মৌলভীবাজারের আগর | বাংলাদেশ আগর এন্ড আতর ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন | ১৯ | ২৩.০৩.২০১৭ |
০৩ | মৌলভীবাজারের আগর আতর | বাংলাদেশ আগর এন্ড আতর ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন | ৩৩ | ১৫.০৭.২০১৯ |
০৪ | মুক্তাগাছার মন্ডা | উপজেলা প্রশাসন, মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ | ৪৪ | ০২.০৫.২০২৩ |
০৫ | যশোরের খেজুরের গুড় | উপজেলা প্রশাসন, চৌগাছা, যশোর | ৪৫ | ২৫.০৫.২০২৩ |
০৬ | নরসিংদীর অমৃত সাগর কলা | জেলা প্রশাসকন, নরসিংদী | ৪৯ | ২৯.০৮.২০২৩ |
০৭ | রাজশাহীর মিষ্টি পান | জেলা প্রশাসক, রাজশাহী | ৫১ | ৩১.০৮.২০২৩ |
০৮ | গোপালগঞ্জের রসগোল্লা | জেলা প্রশাসক, গোপালগঞ্জ | ৪৭ | ২২.০৮.২০২৩ |
০৯ | নরসিংদীর লটকন | জেলা প্রশাসক, নরসিংদী | ৫০ | ২৯.০৮.২০২৩ |
১০ | টাঙ্গাইল শাড়ি | জেলা প্রশাসক, টাঙ্গাইল | ৫৭ | ০৬.০২.২০২৪ |
১১ | জামালপুরের নকশিকাঁথা | জেলা প্রশাসক, জামালপুর | ৩৫ | ২১.০৭.২০১৯ |
প্রক্রিয়াধীন জিআই পণ্যের আবেদন
আবেদন নং | জিআই পণ্যের নাম | আবেদনকারী | উৎপাদন অঞ্চল | আবেদনের তারিখ | |
০১ | জিআই-০৮ | নোয়াখালির মহিষের দুধের দই | জেলা প্রশাসন, নোয়াখালি | নোয়াখালী | ১৩.০২.২০১৭ |
০২ | জিআই-২২ | লতিরাজ কচু | জেলা প্রশাসন, জয়পুরহাট | জয়পুরহাট | ০৭.০৩.২০১৭ |
০৩ | জিআই-১৭ | তরল দুধ | বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন লিমিটেড (মিল্ক ভিটা) | সিরাজগঞ্জ | ১২.০৩.২০১৭ |
০৪ | জিআই-২৪ | নাক ফজলী আম | বদলগাছী উপজেলা নাক ফজলী আম চাষি সমবায় সমিতি লিমিটেড | নওগাঁ | ০৪.০৬.২০১৭ |
০৫ | জিআই-২৫ | সুন্দরবনের মধু | জেলা প্রশাসন, বাগেরহাট | বাগেরহাট | ০৭.০৮.২০১৭ |
০৬ | জিআই-২৬ | ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছানামুখী মিষ্টি | বাংলাদেশ রেঁস্তোরা মালিক সমিতি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শাখা | ব্রাহ্মণবাড়িয়া | ০৮.০৮.২০১৭ |
০৭ | জিআই-৩৮ | ফুটি কার্পাস তুলা | বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড | বাংলাদেশ | ০২.১১.২০২১ |
০৮ | জিআই-৩৯ | ফুট কার্পাস তুলার বীজ ও গাছ | বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড | বাংলাদেশ | ০১.১২.২০২১ |
০৯ | জিআই-৪৬ | সিলেটের মণিপুরি শাড়ি | বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড | সিলেট অঞ্চল | ২৫.০৬.২০২৩ |
১০ | জিআই-৪৮ | মাগুরার হাজরাপুরী লিচু | জেলা প্রশাসন, মাগুরা | মাগুরা | ২৩.০৮.২০২৩ |
১১ | জিআই-৫২ | মধুপরের আনারস | জেলা প্রশাসন, টাঙ্গাইল | টাঙ্গাইল | ০৭.১১.২০২৩ |
১২ | জিআই-৫৩ | মৃৎশিল্প, পটুয়াখালী | বিশ্বশ্বর পাল, বাউফল, পটুয়াখালী | পটুয়াখালী | ১২.১১.২০২৩ |
১৩ | জিআই-৫৪ | পেয়ারা, ঝালকাঠি | সুজন হালদার, ঝালকাঠি সদর | ঝালকাঠি | ৩০.১১.২০২৩ |
১৪ | জিআই-৫৫ | মহিষের দুধের কাঁচা দই | জেলা প্রশাসন, ভোলা | ভোলা | ১৯.১২.২০২৩ |
১৫ | জিআই-৫৬ | শেরপুরের ছানার পায়েস | জেলা প্রশাসন, শেরপুর | শেরপুর | ১৫.০১.২০২৪ |
১৬ | জিআই-৫৮ | টাঙ্গাইলের শাড়ি | বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড | টাঙ্গাইল | ০৭.০২.২০২৪ |
১৭ | জিআই-৫৯ | দিনাজপুরের লিচু | জেলা প্রশাসন, দিনাজপুর | দিনাজপুর | ১২.০২.২০২৪ |
১৮ | জিআই-৬০ | মিরপুরের কাতান | বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড | মিরপুর, ঢাকা | ১৯.০২.২০২৪ |
১৯ | জিআই-৬১ | কুমিল্লার খাদি | বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড | কুমিল্লা | ১৯.০২.২০২৪ |
২০ | জিআই-৬২ | মানিকগঞ্জের হাজারী গুড় | জেলা প্রশাসক, মানিকগঞ্জ | মানিকগঞ্জ | ২০.০২.২০২৪ |
২১ | জিআই-৬৩ | বরিশালের আমড়া | জেলা প্রশাসক, বরিশাল | বরিশাল | ২৫.০২.২০২৪ |
২২ | জিআই-৬৪ | মুসিগঞ্জের পাতক্ষীর | জেলা প্রশাসক, মুন্সিগঞ্জ | মুন্সিগঞ্জ | ২৭.০২.২০২৪ |
২৩ | জিআই-৬৫ | সিরাজগঞ্জের গামছা | বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড | সিরাজগঞ্জ | ০৩.০৩.২০২৪ |
২৪ | জিআই-৬৬ | সিরাজগঞ্জের লুঙ্গি | বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড | সিরাজগঞ্জ | ০৬.০৩.২০২৪ |
জিআই পণ্য কী?
একটি বিশেষ স্বীকৃতি নাম ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই)। মাটি, পানি, আবহাওয়া কিংবা কারিগরের বিশেষ দক্ষতার কারণে অনন্য হওয়া পণ্যকে ভৌগোলিক জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন (জিআই) স্বীকৃতি দেওয়া হয়। মূলত কোনো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের বিশেষ পণ্যকে চিহ্নিত ও পরিচিত করতে ভূমিকা রাখে জিআই স্বীকৃতি। এই স্বীকৃতি আঞ্চলিক পণ্যের স্বতন্ত্র পরিচয় বহন করে তাই নামের উপর গুরুত্ব দিয়ে পণ্যটি কেনার সিদ্ধান্ত নিতে পারে ক্রেতারা।
”কোনো একটি দেশের নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মাটি, পানি, আবহাওয়া ও সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা এবং সেখানকার জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি যদি কোনো একটি পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তা হলে সেটিকে সেই দেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।” —— আমাদের সময়
জিআই স্বীকৃতি কেন দরকার?
একটি বিশেষ পণ্য চেনার জন্য জিআই স্বীকৃতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যেন কোনো পণ্যের বিস্তারিত না জানলেও খ্যাতির উপর নির্ভর করে সেই পণ্যটি ব্যবহার করতে পারে ভোক্তারা। এছাড়াও এটি ভৌগোলিক পরিচিতি বৃদ্ধির পাশাপাশি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর আর্থিক উন্নয়নে অবদান রাখে। সাধারণত উৎপত্তিস্থলের নামে দেওয়া হয় জিআই স্বীকৃতি। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, ঢাকাই জামদানি, রাজশাহী সিল্ক, দিনাজপুর কাটারীভোগ চাল, রংপুরের শতরঞ্জি কিংবা বাংলাদেশের ইলিশ মাছের কথা।
স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে ব্র্যান্ডিং বাড়াতে জিআই স্বীকৃতি গুরুত্ব বহন করে। এছাড়াও রপ্তানিতে বিশেষ অবদান রাখে এই স্বীকৃতি। জিআই সনদ পাওয়ার কারণে বাংলাদেশ ব্যতীত অন্য কোন দেশ সরাসরি ’ইলিশ মাছ’ কিংবা ’জামদানি শাড়ি’ নামে পণ্য রপ্তানি করতে পারবে না। এই দুটি পণ্য পৃথিবীর অন্য কোথাও উৎপাদন হলেও বাংলাদেশের পণ্যগুলোর সাথে শতভাগ বৈশিষ্ট্যে মিলবে না। এ যুক্তির দলিল বহন করে জিআই স্বীকৃতি।
পাশের দেশ ভারতও জামদানি পণ্যের জিআই সনদ পেয়েছে। তবে নামে রয়েছে ভিন্নতা। ভারতের জামদানির নাম ’উপধা জামদানি শাড়ি’ আর বাংলাদেশের ’জামদানি শাড়ি’। ভারতের জিআই পণ্য ’ফজলি আম’ এবং বাংলাদেশের ‘রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম’। একই পণ্য উভয় দেশে হলেও বৈশিষ্ট্যে পার্থক্য রয়েছে।
কোন ধরণের পণ্যগুলো জিআই পণ্যের নিবন্ধন পায়?
কৃষি, হস্তশিল্প, খাবার, প্রাকৃতিক উৎস থেকে সংগ্রহীত কিংবা কারিগর দ্বারা তৈরি হওয়া পণ্যগুলো জিআই স্বীকৃতি পাবে। অর্থাৎ যে পণ্য জিআই নিবন্ধন নিয়মের আওতাধীন পড়ে সেগুলো জিআই নিবন্ধন পেতে পারে। ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন, ২০১৩-তে বলা হয়েছে যেসব পণ্য বাংলাদেশে প্রচলিত কোনো আইনের পরিপন্থী, নৈতিকতার পরিপন্থী, প্রতারণার আশঙ্কা থাকে, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার সম্ভাবনা থাকে, আক্ষরিক অর্থে দেশের ভুখণ্ডের হলেও প্রকৃতপক্ষে অন্য কোন ভূখণ্ডের ইত্যাদি পণ্যের জিআই নিবন্ধনে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
মনোনীত হওয়ার শর্তগুলো:
একটি পণ্য কোনো দেশ, ভূখন্ড, অঞ্চল, এলাকা বা জনপদের মাটি, পানি, আবহাওয়া কিংবা কারিগরের বিশেষ দক্ষতায় অনন্য হতে হয়। সেই পণ্যের সুনাম, ঐতিহ্য ইতিহাস থাকতে হয়। দীর্ঘ সময় ধরে ঐ অঞ্চলে উৎপাদন হওয়ার প্রমাণ— গান, গল্প, কবিতা, বই, সংবাদ কিংবা গেজেট অর্থাৎ পুরাতন দলিল থাকতে হয়। কোন অঞ্চলে উৎপাদন হয়? বিশেষ বৈশিষ্ট্য কী? এই পণ্যের উৎপাদনের সাথে কত মানুষ জড়িয়ে আছে? তাদের জীবনযাত্রা ও আর্থিক উন্নয়নে কতটা ভূমিকা রাখছে? বার্ষিক বিক্রির পরিমাণ কত? এই পণ্যটি একই বৈশিষ্ট্য নিয়ে অন্য কোথাও উৎপাদন হয় কি না? জিআই নিবন্ধন পাওয়ার ক্ষেত্রে এসবের সুস্পষ্ট জবাব থাকতে হয়।
কোন প্রতিষ্ঠান জিআই পণ্যের নিবন্ধন দিয়ে থাকে?
বৈশ্বিক সংস্থা ’ওয়ার্ল্ড ইন্টলেকচুয়্যাল প্রপার্টি অর্গানাইজেশন (WIPO)’ জিআই নিবন্ধন দিয়ে থাকে। বাংলাদেশের পক্ষে জিআই নিবন্ধন দেয় শিল্প মন্ত্রণালয়ের ‘পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি)’। এর জন্য আইন অনুযায়ী ফি, নির্ধারিত ফরম এবং সকল প্রমাণসহ ডিপিডিটি বরাবর আবেদন করতে হয়। তাহলে সকল যাচাই বাছাই শেষ করে আইন মোতাবেক নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ডিপিডিটি।
কারা আবেদন করতে পারে?
পণ্য উৎপাদন, বাজারজাতকরণ, গবেষণা, প্রতিনিধিত্ব কিংবা ব্যবসার উন্নয়নে কাজ করে এমন নিবন্ধিত সমিতি, সংগঠন বা সরকারি প্রতিষ্ঠান (ডিসি অফিস, বিসিক, এসএমই ফাউন্ডেশন, অধিদপ্তর, ইনস্টিটিউট ইত্যাদি) জিআই নিবন্ধনের আবেদন করতে পারে। এখানে উল্লেখ্য যে, জিআই নিবন্ধনের জন্য কোন একক ব্যক্তি আবেদন করতে পারে না এবং জিআই নিবন্ধন কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয় না। এটি একটি ভৌগোলিক স্বীকৃতি।
আরও পড়ুন: জিআই যোদ্ধা তাঁরা: কী করেন, কীভাবে করেন
জিআই পণ্যের আবেদন পক্রিয়া:
সঠিক ও পরিপূর্ণ তথ্য প্রদানের মাধ্যমে জিআই নিবন্ধন ফরম পূরণ করতে হয়। সেখানে আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানের নাম, পণ্যের নাম, বৈশিষ্ট্য, বিশেষত্ব, উৎপাদন পদ্ধতি, ব্যবহার কাল, পণ্যের ক্যাটাগরি, বৈজ্ঞানিক রিপোর্ট, ঐতিহাসিক দলীল, পণ্যের নমুনা, পণ্যের সাদা ও রঙ্গিন ছবি, বাৎসরিক উৎপাদন রেকর্ড, বিক্রির রেকর্ড, উৎপাদন এলাকার মানচিত্রসহ বিস্তারিত তথ্য সংযুক্ত করে একটি ডকুমেন্টেশন তৈরি করতে হয় এবং ফরম পূরণ করে ডিপিডিটি বরাবর পে অর্ডার স্লিপসহ উপস্থিত হয়ে বা ডাকযুগে আবেদন করতে হয়। আবেদন পদ্ধতির একটি চেকলিস্ট ডিপিডিটির ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে। সাধারণত আবেদন করার ১ মাসের মধ্যে রিভিউ করে আবেদনকারী প্রতিষ্ঠান বরাবর ফিডব্যাক দিয়ে থাকে ডিপিডিটি। কোনো তথ্য কিংবা ডকুমেন্টের ঘাটতি থাকলে তা প্রদান করতে হয়।
জিআই ফি এর তালিকা:
জিআই পণ্যের কয়েক ধরণের ফি রয়েছে। তা কয়েকধাপে পরিশোধ হয়।
প্রথম ধাপ: পণ্যের শ্রেণির উপর ভিত্তি করে আবেদন ফি নির্ধারিত হয়। যদি একটি পণ্যের একটি শ্রেণি হয় তাহলে ডিপিডিটি বরাবর ১৫ হাজার টাকা ব্যাংক ড্রাফট বা পে অর্ডার করতে হয়। আর পণ্যটি ২টি শ্রেণি হলে আবেদন ফি পরিশোধ করতে হয় ৩০ হাজার টাকা। সাথে ১৫% ভ্যাট প্রদান করতে হয়।
দ্বিতীয় ধাপ: জার্নাল প্রকাশের পর সার্টিফিকেট ইস্যুর জন্য ৩ হাজার টাকা ফি ও ১৫% ভ্যাট দিতে হয়।
তৃতীয় ধাপ: জিআই নিবন্ধন পাওয়ার পর উৎপাদনকারীরা রেজিস্ট্রার ইউজার হওয়ার জন্য একজন উৎপাদনকারী ১ হাজার টাকা ও ১৫% ভ্যাট দিতে নিবন্ধন ও সনদ নিতে হয়।
এছাড়াও আরও কয়েক ধাপে ফি রয়েছে। যেমন: জার্নাল প্রকাশের পর অন্য অঞ্চলের পণ্য হিসেবে দাবি করতে চাইলে কিংবা জিআই সনদের নবায়ন ইত্যাদি। জিআইয়ের সবধরণের ফি সম্পর্কে জানতে ক্লিক করুন।
জিআই সনদের মেয়াদ ৫ বছর। মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্বে নবায়ন করতে হয়।
জিআই জার্নাল কেন?
জিআই পণ্যের জন্য জার্নাল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি জিআই আবেদনের সকল যাচাই বাছাই শেষ করে প্রাথমিক অনুমোদনের পর সরকারের বাংলাদেশ সরকারী মুদ্রণালয় থেকে গেজেট বা জার্নাল প্রকাশ করা হয়। এরপর সেই জার্নাল নির্দিষ্ট কিছু স্থানে প্রিন্ট কপি রাখার পাশাপাশি ডিপিডিটির ওয়েবসািইটে প্রকাশ করা হয়। যেন মানুষ সেই পণ্যের জার্নাল সম্পর্কে জানতে এবং কোন বিরোধিতা থাকলে নিয়ম মেনে তা ডিপিডিটি বরাবর করতে পারে। জার্নালকে জিআই এর প্রাথমিক স্বীকৃতিও বলে কেউ কেউ। ২ মাসের মধ্যে কোন পণ্যের জিআই স্বীকৃতি নিয়ে বিরোধীতা না আসলে ডিপিডিটির মহাপরিচালক সেই পণ্যকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেন। অর্থাৎ সনদ ইস্যু করেন। এছাড়াও জিআই তালিকাভুক্ত হওয়ার পর রেজিস্ট্রার উৎপাদনকারীদের তালিকা প্রকাশ করা হয় নতুন জার্নালে।
জিআই পণ্যের নিবন্ধন বাড়লে জেলার লাভ কী?
জিআই নিবন্ধন পাওয়া পণ্যগুলো দেশের কোনো না কোনো ভৌগোলিক এলাকায় উৎপাদন হয়। তাই সাধারণত ঐ অঞ্চলের নামে জিআই নিবন্ধন আবেদন করা হয়। তবে কিছু কিছু আবেদন শুধু পণ্যের নামেও করা হয়। যেমন: জামদানি শাড়ি।
জেলার নাম সংযুক্ত করে আবেদন করলে পণ্যের সাথে জড়িয়ে যায় জেলা ব্র্যান্ডিং আর জেলার নাম না থাকলেও পণ্যের ব্র্যান্ডিং, চাহিদা, উৎপাদন, আয় সবকিছুর সুবিধা ভোগ করে জেলার উৎপাদনকারীরা। যার ফলে বৃদ্ধি পায় ঐ জেলার অর্থনীতিক ও কর্মসংস্থান।
পণ্যের শ্রেণি বা NICE classification
নিস চুক্তির অধীনে ট্রেডমার্ক ও জিআই নিবন্ধনের জন্য পণ্য ও সেবার আন্তর্জাতিক শ্রেণীভুক্তকরণ পণ্যসমূহ:
- শিল্প কারখানা, বিজ্ঞান, আলোকচিত্র, কৃষি, উদ্যানবিদ্যা এবং অরণ্যে ব্যবহৃত রাসায়নিক দ্রব্য; অপ্রক্রিয়াজাত কৃত্রিম রজন, অপ্রক্রিয়াজাত প্লাস্টিক; সার; অগ্নি নির্বাপক উপাদান; পেম্পারিং ও সোলাডারিং প্রিপারেশন, খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণে রাসায়নিক উপাদান; চামড়া পাকা করার উপাদান; শিল্প কারখানায় ব্যবহৃত আঠা।
- রঙ, বার্নিশ; জং প্রতিরোধে ও কাঠের ক্ষয় রোধে ব্যবহৃত প্রিজারভেটিভ; কালার্যান্টস; মর্ডারেন্টস; অপরিশোধিত প্রাকৃতি রজন; ফয়েলে ব্যবহৃত ধাতু এবং চিত্রশিল্পী, ডেকোরেটর, ছাপাখানা এবং শিল্পীদের ব্যবহৃতহ পাউডার।
- দ্রুত আপডেট হবে…
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, আওয়ার শেরপুর।